শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১:২৫ পূর্বাহ্ন

অস্ত্রোপচারে আলাদা হয়ে বাড়ি ফিরছে রুহি-জুহি

  • আপডেট সময়: শুক্রবার, ২২ আগস্ট, ২০২৫
  • ৩৭ দেখেছেন :

অনলাইন ডেক্স

জুহি ও রুহির মাথায় প্রজাপতি লাগানো লাল ব্যান্ড। কালচে সবুজ রঙের ফ্রক গায়ে। কপালের কোনায় বড় কালো টিপ আর ভ্রুতে কাজল দেওয়া। চুড়ি, মালাও পরেছে। যমজ দুই বোন শরীরের পেছন দিকে জোড়া লাগানো অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল আট মাস আগে। সাত মাসের সময় অস্ত্রোপচার হয়। তারা এখন আলাদা আলাদা মানুষ। আজ বৃহস্পতিবার একজন বাবা, আরেকজন মায়ের কোলে চড়ে বাড়ি ফিরছে।

রুহি-জুহির বাড়ি ফেরা উপলক্ষে আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রেনিং কমপ্লেক্সে বিদায় অনুষ্ঠানে দুই বোন সাজুগুজু করে হাজির হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরাও এ দুজনকে কোলে নিয়ে ছবি তুলছিলেন। একজন তাদের মা-বাবার কাছে আবদার করলেন, মেয়েদের বিয়েতে কিন্তু দাওয়াত চাই।

দুই বোনের বয়স এখন ৮ মাস ২৩ দিন। গত ২৪ জুন চার ঘণ্টার অস্ত্রোপচার শেষে তাদের আলাদা করেছেন চিকিৎসকেরা। এ অস্ত্রোপচারে নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের (ইউনিট-২) অধ্যাপক কানিজ হাসিনা। এই হাসপাতালে জোড়া লাগানো যমজ আলাদা করার সফল হওয়ার তালিকায় রুহি ও জুহি চার নম্বরে আছে।

নীলফামারীর জলঢাকার ওবায়দুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জে রিকশা চালান। স্ত্রী শিরিনা বেগম। আলট্রাসনোগ্রাম করে জানতে পেরেছিলেন, এই দম্পতি যমজ সন্তানের মা–বাবা হতে যাচ্ছেন। রংপুরে এক ক্লিনিকে অস্ত্রোপচারে সন্তানদের জন্মের পর দেখলেন, তারা জোড়া লাগানো।

এরপর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে জন্মের ১৪ দিনের মাথায় গত ১২ জানুয়ারি মেয়েদের নিয়ে এই মা–বাবা এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই থেকে হাসপাতালের একটি কেবিনই ছিল ঠিকানা। রুহি-জুহির পুষ্টি ঠিক রাখাসহ অন্যান্য বিষয় পর্যবেক্ষণে রাখার জন্যই হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। আজ সেই অস্থায়ী ঠিকানা ছেড়ে দুই বোন যাচ্ছে দাদাবাড়ি।

রুহি-জুহির বিদায় অনুষ্ঠানে অধ্যাপক কানিজ হাসিনা বলেন, দুজনের পেছন দিকে মেরুরজ্জু জোড়া লাগানো ছিল (পাইগোপেগাস)। তবে তাদের পায়ুপথ ও যৌনাঙ্গ আলাদা ছিল। অস্ত্রোপচার–পরবর্তী সময়ে প্রস্রাব-পায়খানায় নিয়ন্ত্রণ না থাকা, পা নাড়াতে না পারা, মস্তিষ্কে জটিলতাসহ নানান জটিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। সংক্রমণের ভয় ছিল। তবে তারা এসব ঝুঁকি থেকে আপাতত মুক্ত। তাদের দীর্ঘ মেয়াদে ফলোআপে থাকতে হবে। তাদের অস্ত্রোপচার খালি চোখে দেখে নয়, পোর্টেবল মাইক্রোস্কোপ মেশিন দিয়ে করা হয়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক।

হাসপাতালে ভর্তির সময় রুহি ও জুহির দুজনের একসঙ্গে ওজন ছিল ৩ দশমিক ৬ কেজি। আর আজ জুহির ওজন ছিল সাড়ে ৫ কেজি আর রুহির সাড়ে ৬ কেজি।

অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে রুহি ও জুহির বাবা ওবায়দুল ইসলাম চিকিৎসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মেয়েদের নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন, সে কথা বলতে গিয়ে আবেগে কেঁদে ফেলেন। আর মা শিরিনা বেগম তাঁর মেয়েদের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন।

জন্মের পর যখন মেয়েদের জোড়া লাগানো দেখেছিলেন, তখনকার অবস্থা বর্ণনা করার সময় এই মা যেন আবার সেই সময়কে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলেন। তবে যখন দেখলেন অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে, মেয়েরা আলাদা হয়েছে, এ কথা বলার সময় এই মায়ের মুখে ছিল হাসির ঝিলিক। সেই হাসি ছড়িয়ে যায় সেখানে উপস্থিত শিশু সার্জারি বিভাগ, প্লাস্টিক সার্জারি, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, নিওনেটোলজি, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং, অর্থোপেডিক, নবজাতক বিভাগ, নিউরোসার্জারি, অ্যানেসথেসিওলজিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে।

রুহি ও জুহিকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করার সময় যেসব সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী যুক্ত ছিলেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

হাসপাতালের পরিচালক আরও জানান, আট মাস রুহি ও জুহিকে কেবিনে রাখা হয়েছে বিনা মূল্যে। ওষুধ কেনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে চিকিৎসকেরাও সহায়তা করেছেন। মা–বাবার খাবারসহ কিছু ব্যক্তিগত খরচ হয়েছে পরিবারটির। হাসপাতাল ছাড়ার পরও এই পরিবারের পুনর্বাসনে হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগের মাধ্যমে কীভাবে সাহায্য করা যায়, তা নিয়ে পরিচালক অনুষ্ঠানেই কথা বলেন সমাজসেবা বিভাগের প্রতিনিধির সঙ্গে।

আসাদুজ্জামান বলেন, রুহি-জুহিকে আলাদা করার যাত্রাটা সহজে শেষ হবে না, তা জানতেন চিকিৎসকেরা। তার পরও তাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন। এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই বিনা মূল্যের চিকিৎসায় মা–বাবা মেয়েদের নিয়ে হাসিমুখে আজ বাড়ি ফিরতে পারছেন।

হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ছামিদুর রহমান, অধ্যাপক আবদুল হানিফ টাবলু, অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক তাহমিনা সাত্তার, চিকিৎসক ছাদরুদ্দীন আল মাসুদ, হাসপাতালের উপপরিচালক চিকিৎসক আশরাফুল আলম, হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগের প্রতিনিধি দীপিকা রানী সাহা প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনেকে রুহি–জুহিকে আলাদা করার ক্ষেত্রে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথাও শোনান।

যমজ দুই বোন প্রায় একই চেহারার। কোনটা রুহি কোনটা জুহি, চেনেন কীভাবে—এমন প্রশ্নে ওবায়দুল ইসলাম কিছুটা বিরক্তিই প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘মা–বাবা নিজেদের মেয়েদের চিনব না?’ মা শিরিনা বেগম জানালেন, জুহির পায়ে জন্মদাগ আছে। আর মেয়েদের মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারেন কোনটা কে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অনন্য ক্যাটাগরির সংবাদ
© All rights reserved © Comillakantha.com
Theme Customized By Mahfuz