
স্টাফ রিপোর্টার :
কুমিল্লায় পুলিশের অভিযানে ইয়াবাসহ আটকের কয়েক ঘন্টা পর ‘পুলিশ হেফাজতে’ মারা যাওয়া ইন্টারনেট ব্যবসায়ী শেখ জুয়েলকে নিজেদের কর্মী দাবি করছে স্থানীয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। বৃহস্পতিবার বিকালে জুয়েলসহ ৫ ব্যক্তিকে আটকের পর রাতে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শেখ জুয়েলের (৪৫) মৃত্যু হয়। তিনি মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা গ্রামের প্রয়াত শেখ গোলাম সারোয়ারের ছেলে। পুলিশের নির্যাতনে তিনি মারা গেছেন বলে স্থানীয় বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও পরিবার দাবি করেছে। শুক্রবার দুপুরে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে তার মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনে একাধিক জখমের কথা উল্লেখ করেছেন। এদিকে বাঙ্গরা থানা পরিদর্শন শেষে গতকাল বিকালে কুমিল্লা পুলিশ সুপার মো. নাজির আহমেদ খান বলেছেন ‘পুলিশ হেফাজতে ওই বক্তিকে নির্যাতন করা হয়নি, তিনি আগে থেকেই হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন, বুকের ব্যথা শুরু হলে হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি (জুয়েল) মারা যান।’
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত :
বাঙ্গরা বাজার থানা পুলিশ জানিয়েছে, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে বাঙ্গরা বাজার ব্রিক ফিল্ড এর পূর্ব পাশে মাদক ব্যবসায়ী হেলালের বাড়ি থেকে ৭০ পিস ইয়াবাসহ জুয়েল ও তার ৪ সহযোগীকে আটক করা হয়। আটক ৫ জনের বিরুদ্ধে সন্ধ্যায় মাদক আইনে মামলা হয়। জুয়েল ছাড়া অপর ৪ জন হচ্ছেন, বাড়ির মালিক বাঙ্গরা গ্রামের মাদক ব্যবসায়ী মোঃ হেলাল (৪২), তার স্ত্রী শারমিন প্রকাশে সখিনা (৩৫), একই গ্রামের খোকন (৪৫) ও পাশের দৌলবাড়ি গ্রামের মোঃ হান্নান (২১)।
বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘রাতে থানা হাজতে জুয়েল বুকের ব্যথার কথা জানালে তাকে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এটা স্বাভাকি মৃত্যু। পুলিশ তাকে নির্যাতন করেনি। ওসির ভাষ্য ‘মাদক ব্যবসায়ী হেলালের বাড়ি থেকে জুয়েলসহ যাদের আটক করা হয় তারা সকলেই মাদক সেবন ও বিক্রির সাথে জড়িত। হেলালের বিরুদ্ধে মাদকের ৪টি মামলা আছে।’
তবে জুয়েলের স্ত্রী শিল্পী বেগম বলেন, তার স্বামী মাদক সেবন কিংবা বিক্রিতে জড়িত ছিলেন না। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আমার স্বামী ইন্টারনেটের বিল কালেকশন করতে যায়। দুপুরের পরপরই খবর পাই যে আমার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পরে থানায় গিয়ে স্বামীর সাথে দেখা করি। তখনও তিনি সুস্থ ছিলেন। রাতে খবর পাই আমার স্বামীকে মুরাদনগর হাসপাতালে নিয়ে গেছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার স্বামী আর বেঁচে নেই। পুলিশ আমার স্বামীকে মেরে ফেলছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমি স্বামী অনেক আগে স্ট্রোক করেছিল, অনেকদিন ধরে সুস্থ ছিলেন। এখন তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন বলে পুলিশ প্রচার করছে।’ এদিকে জুয়েলের মৃত্যুর খবর এলাকায় জানাজানি হলে স্থানীয় লোকজন গভীর রাত পর্যন্ত বাঙ্গরা বাজার থানার সামনে বিক্ষোভ করে। খবর পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।
জুয়েলকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কর্মী দাবি :
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূইয়া বলেছেন, জুয়েল আমাদের দলের (বিএনপি) সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাঁর ভাই শাহ পরান বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। জুয়েলকে পুলিশ পরিকল্পিতভাবে নির্যাতনে হত্যা করেছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি করেছেন। সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের ছোট ভাই কাজী শাহ আরফিন ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘মুরাদনগরের বাঙ্গরা থানায় পুলিশের হেফাজতে বিএনপির একজন কর্মী নিহত হয়েছেন, যার বিরুদ্ধে কোনো মামলাই ছিল না। এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
তবে মুরাদনগর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক শাহেদুল আলম শাহেদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে শেখ জুয়েলকে বাঙ্গরা ইউনিয়ন যুবলীগের ৩ নং ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দাবি করে একটি পোস্ট দেন। জুয়েলের চাচাতো ভাই স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, ‘সে (জুয়েল) আমার সাথে রাজনীতি করতো। তবে ৫ আগস্টের পর তো এখন সবাই বিএনপি।’ শেখ জুয়েলের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতেও জাতীয় ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বেশ কিছু পোস্ট দেখা গেছে।
সুরতহাল প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে
মুরাদনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্্েরট মো. সাকিব হাছান খাঁন জুয়েলের মরদেহের সুরতহাল তৈরী করেছেন। এতে বড় ধরনের কোন জখমের কথা উল্লেখ করা হয়নি। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, জুয়েলের ডান হাতের কবজির উপরে দুটি আধা ইঞ্চি পরিমান আচরের দাগ, পিটের ডান দিকে দেড় ইঞ্চি পরিমান আঘাতের চিহৃ, কোমড়ের বাম পাশে ৩ ইঞ্চি পরিমান আচরের চিহৃ,বাম পায়ে হালকা রক্তাক্ত ক্ষত চিহৃ ও পেছনে ৩ ইঞ্চি পরিমান আচরের দাগ। তবে পুলিশ বলেছে জুয়েলকে গ্রেপ্তার ও থানা থেকে হাসপাতালে নেয়া হয় গাড়িতে। এতে উঠানো নামানোর সময় হয়তো তার শরীরে এসব আচর ও জখম হয়েছে। এসব জখম নির্যাতনের নয় বলে পুলিশ দাবি করেছে।
মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সিরাজুল ইসলাম মানিক বলেন, পুলিশ রাত আটটা ৫০ মিনিটে ভিকটিমকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাকে মৃত দেখতে পাই। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
কুমেক হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক মিল্টন কুমার দেবনাথ বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে লাশের ময়নাতদন্ত করেছি। সুরতহালে মরদেহের বিভিন্ন স্থানে কিছু আঘাত চিহ্ন ও ক্ষত চিহেৃর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এসব আঘাতে নাকি অন্য কারণে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে তা নিশ্চিত হতে মরদেহ থেকে প্রয়োজনীয় বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রায় তিন মাসের মধ্যে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হতে পারে।
গতকাল বিকালে কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. নাজির আহমেদ খান বলেন, পুলিশ ওই ব্যক্তিকে কোনও ধরনের মানসিক কিংবা শারীরিক নির্যাতন করেনি। পরিবারের পক্ষ থেকে নির্যাতনে জুয়েলের মৃত্যুর অভিযোগটি সঠিক নয়। পুলিশ সুপার আরও বলেন, থানা হাজতে আরও অনেক আসামি ছিলেন। তারাও সব প্রত্যক্ষ করেছেন। সিসিটিভির ফুটেজও আমাদের নিকট আছে। মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসবে, সেই অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।