
কুমিল্লা কণ্ঠ রিপোর্ট :
কুমিল্লা বিমানবন্দর। দেখলে বোঝার উপায় নেই এক সময় এখানে বিমান উঠানামা করতো। এখানে মানুষের পদচারণায় মুখর ও কর্মব্যস্ততা ছিলো। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত থাকায় রানওয়ের শক্তি পিসিএন (পেভমেন্ট ক্ল্যাসিফিকেশন নম্বর) নষ্ট হয়ে গেছে। সুবিশাল রানওয়েতে উড়ছে ধুলাবালি। বিমান বন্দরের সংরক্ষিত অধিকাংশ এলাকায় ঘাস ও ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে। বেদখলও হয়েছে অনেক। ভেঙ্গে গেছে পিস ঢালাই ও ব্লক। যত্নের অভাবে এগুলোর রুগ্ন দশা। এ বিমানবন্দরে বর্তমানে জনবল আছে ২৪ জন। তবে বিমান উঠানামা না করলেও এ বিমানবন্দরে থাকা যন্ত্রপাতির সহায়তায় সিগন্যাল ব্যবহার করে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক রুটে ৩৫-৪০টি বিমান চলাচল করছে। যা থেকে সরকার প্রতি মাসে প্রায় আড়াই কোটি টাকার রাজস্ব আয় করছে। বিমানের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সদিচ্ছা, কিছু জনবল আর কিছু টাকা ব্যয়ে রানওয়ে মেরামত করলেই এখনই আভ্যন্তরীন রুটে চালু সম্ভব দেশের অন্যতম প্রাচীন কুমিল্লা বিমানবন্দর।
বিমানবন্দরের একাধিক সূত্র জানায়, দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের জন্য চালু করা হচ্ছে পরিত্যক্ত সাত বিমানবন্দর। পর্যটন শিল্পের বিকাশ, সড়ক ও রেলপথে চাপ কমানো এবং অর্থনীতি চাঙা করতে দেশের বিমানবন্দরগুলো ক্রমান্বয়ে আবার চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো পর্যায়ক্রমে সচল করা হবে। বর্তমানে দেশে সাতটি বিমানবন্দর পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এগুলো হলো- বগুড়া, লালমনিরহাট, শমসেরনগর, ঈশ্বরদী, ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা ও তেজগাঁও বিমানবন্দর। এর মধ্যে বিমান উঠা নামা না করলেও লাভজনক আছে কুমিল্লা বিমানবন্দর।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ১৯৪১-৪২ সালে কুমিল্লা শহরতলীর দক্ষিণে ৩ কিলোমিটার দূরে নেউরা, ঢুলিপাড়া, রাজাপাড়া ও দিশাবন্দসহ কয়েকটি এলাকার ৭৭ একর জমিতে এ বিমানবন্দরটি স্থাপন করে যুক্তরাজ্য। যুদ্ধের পর ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এই বিমান বন্দর হতে তেজগাঁও পুরান বিমান বন্দরে অভ্যন্তরীন বিমান চলাচল করত। এসময় ঢাকার জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (বর্তমানে হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর) স্থাপিত হওয়ার পর থেকে কুমিল্লা বিমানবন্দরে বিমান উঠা নামা বন্ধ হয়। সর্বশেষ ১৯৯৪ সালে আবারো চালুর পর যাত্রী সংকটে তা বন্ধ হয়ে যায়।
বিমান সূত্র জানায়, দেশে সাতটি শর্ট টেক অফ অ্যান্ড ল্যান্ডিং (স্টল) বিমানবন্দর রয়েছে। এই সাতটির একটি হলো কুমিল্লা বিমানবন্দর। এটির সিগন্যাল সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ভারতের অভ্যন্তরীণ রুট, ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুরের বিমান। আগরতলা বিমানবন্দরে যাওয়া বিমানও এ রুটে চলাচল করে। এর সিগন্যালিং থেকে প্রতিমাসে আয় হচ্ছে গড়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকা।
এদিকে কুমিল্লার সাথে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলের জন্য বেশ বেসরকারি কয়েকটি এয়ারলাইন্স আগ্রহী। ইউএস বাংলা’র মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) মো. কামরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশের অন্যতম প্রবাসী অধ্যুষিত জেলা কুমিল্লা। এখানে ইপিজেড, বিসিক, কয়েকশ শিল্পকারখানায় রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ রাখতে হয়। এছাড়াও কক্সবাজারের সাথে পর্যটকদের যাতায়োতেও সম্ভবনাময় এ বিমানবন্দর। বিমানবন্দর চালু চলে ২৫ মিনিটে ঢাকা এবং প্রায় ৪০ মিনিটে কক্সবাজার যাতায়াত সম্ভব। ওই কর্মকর্তার ভাষ্য এ বিমানবন্দরটি চালু করতে আমরা বেশ কয়েক বছর যাবৎ সরকারের সাথে কাজ করছি। এ বিমানবন্দর চালু হলে বৃহত্তর কুমিল্লার প্রবাসী ছাড়াও ব্যবসায়ী, সাধারণ লোক ও পর্যটকরা উপকৃত হবে।
কুমিল্লা বিমানবন্দরের সিএনএস প্রকৌশলী নাছির উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে এখানে নেভিগেশন ফ্যাসিলিটিস, ডিভিওআর, ডিএমই, ভিসেট, অন্যান্য এয়ার কমিউনিকেশন যন্ত্রপাতি, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটর, যাত্রীদের জন্য আলাদা রুমও আছে। এটি চালু করতে খুব বেশি অর্থেরও প্রয়োজন নেই। শুধু উদ্যোগ নিয়ে রানওয়ে মেরামত, রানওয়ের দুই পাশে লাইট স্থাপন, লাগেজ স্কেনার, পার্কিং, ফায়ার সার্ভিস ও এটিসি টাওয়ারের কয়েকজন জনবল এবং কিছু যন্ত্রপাতি আনা হলেই এ বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে স্টল বিমান চলাচল শুরু করা সম্ভব।
কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্স এণ্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি ডা. আজম খান নোমান জানান, ‘কুমিল্লা বিভাগ না হলেও বিভাগীয় সব দপ্তর রয়েছে এ জেলায়। দেশের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী জেলা হিসেবেও কুমিল্লার অবস্থান এখন শীর্ষে। বিমানবন্দরটি চালু হলে কুমিল্লার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সব ক্ষেত্রে যোগ হবে নতুন মাত্রা।’
কুমিল্লা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব জানান, কিছু বিদেশী বিনোয়োগকারী মাঝে মধ্যে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে এসে পুরাতন এ বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ঢাকা চট্টগ্রামের মাঝে অবস্থিত প্রাচীন জেলা কুমিল্লায় ক্রমেই ব্যবসা বাণিজ্যের সমৃদ্ধি ঘটছে। তাই এ বিমানবন্দরটি চালু হলে কুমিল্লা ইপিজেডসহ আশপাশের এলাকায় আরো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী আসবে।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকায় বিমানের একটি সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের পুরো জমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তাই প্রয়োজনীয় জমি হস্তান্তর করে এ বিমানবন্দর চালু করতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কে উচ্চ পর্যায়ের যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। না হয় মাঝ পথে এসে চালুর উদ্যোগটি আটকে যাওয়ার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুমিল্লা বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এ বিমানবন্দর চালুর বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর আসলেও সরকারিভাবে কোন চিঠি এখনো আসেনি। তবে চালুর বিষয়ে আমরাও চেষ্টা করছি। ফ্লাইট চালু না থাকলেও প্রতিদিনই এখান থেকে সিগন্যাল ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক রুটের ৩৫-৪০টি বিমান চলাচল করছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দও যা সম্পূর্ণ তদারকি করছে। এতে সরকারের বিপূল পরিমান রাজস্ব আয়ও হচ্ছে।